obaydulbc Trainer 2 years ago |
বিকেলের দিকে ঠিক যখন ঝিঙে ফুল ফোটে এ বাড়ির মেয়েরা চুল
বাঁধতে বসে। ভাত ঘুম এ কালের মেয়েদের নিষিদ্ধ, এত বাবুয়ানি চলে
না। অবশ্য সময়ও হয় না । দুবেলা দুই হেঁসেলে গুষ্টির রান্না করতে
হিমশিম খায় এ বাড়ির আশ্রিত মেয়েরা। আঁশ হেঁসেলে মাইনে করা দু
জন বামুন ঠাকুর আর নিরামিষে একজন। বাড়ির আশ্রিত মেয়ে বউরা
কুটনো কুটে, বাটনা বেটে, চাল ডাল বেছে তাদের রান্নার যোগান যোগান
দেয়। ছোটদের পর কর্তাদের, তার পর আশ্রিত, চাকর, মজুর সকলকে
খাইয়ে সব বউরা যখন খেতে পায় সূর্যদেব তখন পশ্চিম দিকে ঢলতে
শুরু করেন। মুখ আঁচিয়ে দাওয়ায় বসতে না বসতেই নাপিত বউ বিমলা
এসে হাজির হয়। এই সময়টুকুই যা একটু গল্প গাছা, নিন্দা চর্চার
অবসর। নাপিত বউ বাড়ির অন্য ঝি, পাড়া বেরুনি আশেপাশের বউ ঝি
সবাই মিলে বিকেল বেলাটায় মজলিস বসায়। এরই মধ্যে বাচ্চা কাচ্চারা
খ্যান খ্যান করে, কোন খেলনা বা মিঠাইএর জন্য বায়না ধরে। বিরক্ত
মায়েরা কখনো বিরক্ত হয়ে তাদের পিঠে গুম গুম করে কিল মারে
কখনো বা কোলের কাছে টেনে নিয়ে আদর করে ভোলানোর চেষ্টা করে।
কারোর সই তাস খেলা বা বাঘ বন্দী খেলার জন্য ডাক দেয়। কখনো
কোন বালিকার সাধের রুপোর নুপুর হারায়। কারোর বা চুলের কাঁটা।
আশ্রিত মেয়ে বউ নিজেদের কোন জিনিস হারালে এ ওকে সন্দেহ করে।
কোন্দল করে। কখনো কখনো সে সব হাতাহাতি চুলোচুলির পর্যায়েও
পৌঁছোয়। ছোট ছোট মেয়ে গুলো এমন শুরু করে তা আর বলার নয়।
মেয়েদের মধ্যে চুলোচুলি শুরু হলে ওদের মা বা খুড়িমারা এসে দু ঘা
দিয়ে ছাড়িয়ে নেয়। কখনো বা তাদের মায়েদের মধ্যেও এই নিয়ে ঝগড়া
লেগে যায়। পরস্পরকে দোষারোপ করে, শাপশাপান্ত করে। তবে বাড়ির
মূল সদস্যদের দেখে ওরা চুপ করে যায়।
এ বাড়ির অন্দরমহল নিস্তারিণী দেবীর রাজত্ব। এখানে আর কারোর
কথা চলে না। তাঁর প্রবল ব্যক্তিত্বের সামনে কারোর মুখ তুলে কথা বলার
সাহস হয় না। যে কোন গোলমাল তাঁর কানে ওঠার আগেই নিজেদের
মধ্যে মিটিয়ে ফেলতে হয়। নিস্তারিণী দেবী ক্রুদ্ধ হলে আর রেহাই নেই।
অবশ্য কেউই জানেন না তিনি কুপিত হলে কোন শাস্তি খাঁড়া মাথার
ওপর নেমে আসতে পারে। এর আগে তেমন কোন উদাহরণ সৃষ্টি হয়নি।
কিন্তু সবাই তাঁকে সমীহ করে চলে।
আজকের মজলিসের আলোচ্য বিষয় এ বাড়িরই নতুন বউ, ছোট বউ
কুসুম কুমারী। সেই দশে বিয়ে হয়ে এতটা কাল সে বাপের বাড়িতেই ছিল
। তেরোতে শ্বশুর ঘর করতে এসে পাঁচ মাসেই পোয়াতি হয়ে পড়েছে। সে
খবর জেনে তার দিদি শাশুড়ী যেন তাকে নিয়ে মাথায় করে নাচছেন।
নতুন বউয়ের নিজের শ্বশুর শাশুড়ি বেঁচে নেই, আছেন শুধু দিদি
শাশুড়ি। অবশ্য সে জন্য তার কোন অসুবিধে নেই।
অনেকটা জমি জুড়ে বাঁড়ুজ্যেদের ভদ্রাসন। আত্মীয় পরিজন -
আশ্রিতরা সংখ্যায় অনেক হলেও মূল উত্তরাধিকারী যারা হতে পারেন
তাঁরা সংখ্যায় কম। ও তরফের আর এ তরফের দুই পুত্র সন্তান। একজন
সদ্য কিশোর আর অন্য জন সদ্য যুবক। সদ্য যুবক রাধকান্ত কিশোর
বিষ্ণুচরণের খুড়ো। নীলমণি বাঁড়ুজ্যে রাধকান্তের সৎ বড় ভাই, পাঁচ
কন্যার মধ্যে বর্তমানে জীবিত দুই কন্যা আর এক পুত্রের পিতা। বাকি
তিন কন্যা নিতান্ত শিশু অবস্থায় মারা গিয়েছে। এক জন ঘর জামাই স্ত্রী
সহ শ্বশুরের ভিটেতে বসবাস করে, এছাড়াও অনেক আশ্রিত আছে।
তারা কলহ বিবাদও করে। যদিও অনতিবিলম্বে সেসব মিটে যায় ।
বাঁড়ুজ্যেরা শুধুমাত্র জমিদার নন, প্রচুর সম্পদের মালিক। ওঁদের নিজস্ব
লেঠেল বাহিনী আছে।
মেয়েদের মজলিসে নাপিত বউ ও তরফের ছোট মেয়ে রতনমনির চুল
বাঁধতে বাঁধতে ফিসফিস করে বলল, "হ্যাঁ গা রতন দিদি তোমাদের নতুন
বৌ কোথায় গা?"
সুন্দরী রতনমনি মুখ বেঁকিয়ে বলল, "জনে জনে সবার খবর রাখি নে
বাপু, তোর অত কথায় কাজ কী? তুই তোর নিজের কাজ কর দেখি! নে
বাপু ভাল করে তেল ঠেসে তবে মাথা বাঁধবি। সক্কাল থেকে যন্তনায়
মোট্টে মাথা তুলতে পারছি নে।"
নাপিত বউ বিমলা সারা গাঁয়ের খোঁজ রাখে। গাঁয়ের প্রতিটি বাড়ির
রসাল খবরের যোগানদার। এত সহজে হার মানার পাত্রী সে নয়।
রতনমণির কথার ঝাঁজেই বুঝতে পেরেছে নির্ঘাত নতুন কোন গল্প
আছে। সে ভাল মানুষের মতো মুখ করে বলল, "ওমা এই দেখ রাগ করে
কেমন! ভালো কথাই তো কইলেম বাবা। বেলা পড়ে আসছে সে মাথা
বাঁধবে নে,আলতা পরবে নে?"
রতনমনি মাথা নেড়ে নথ দুলিয়ে বলল,
"সে এখন তার দিদি শাউরির পেয়ারের বউ গো, পোয়াতি কিনা।
সক্কলের আগে খেয়ে ভাত ঘুম দিচ্ছেন। কালে কালে কত দেখব। এ
বাড়ির কোন বউ ঝি তো আর বাচ্চা পেটে ধরে নি। "
নাপিত বউ বিমলা গালে হাত দিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, "ওমা গো
মা! সে কি কথা গো, বলি কত্তাদের আগে ও খায় নাকি? চেরটা কাল
শুনে এলাম যে আগ বোল ভাত নাকি মেয়ে মানুষ খায় নে । সমসারের
অকল্যাণ হয়। তার পর গলা খাটো করে বলল, "শউর সোয়ামীর আগে
অন্ন মুখে তোলা মানেই ধরে নাও তাদের আয়ু গিলে নেওয়া। এতো মহা
পাতকের কাজ গো। তোমাদের বাড়ির হলটা কি?'
রতন ততক্ষনে খোঁপার সোনার কাঁটা গুলো খুলে কোল আঁচলে জড়ো
করে বলল,"দিনু কবরেজের বিধেন, আমরা মুক্কু শুক্কু মেয়ে মানুষ,
আমাদের আর কি জ্ঞান বল?"
রতন কোল আঁচল থেকে দশটা সোনার কাঁটা গুনে হাতের মুঠোতে ধরে
রাখল। ওর বেশ মনে আছে, দুবছর আগে যখন ও পোয়াতি ছিল তখন
একদিন এই মেয়ে মজলিসেই গল্প করতে করতে ওর শরীরটা হঠাৎ করে
খুব খারাপ করে উঠল। পেটের মদ্দিখানে একটা অদ্ভুত যন্তনা যেন পাক
দিতে লাগল। সবিকে নিয়ে পুকুর পাড়ে গেল, তারপর আর তার জ্ঞান
ছিল না। সবি দৌড়ে বাড়ি এসে আছড়ে পড়েছিল, "ওগো তোমরা রতন
দিদিরে বাঁচাও গো! ও মা গো! সেকি অক্ত গো কী অক্ত!
সবাই মিলে ওকে পুকুর পাড় থেকে তুলে এনেছিল। দিনু কবরেজ এসে
দেখে শুনে বলেছিল গর্ভপাত হয়েছে। তা সে হতেই পারে।
আজকালকার মেয়ে বৌরা তো আগের দিনের মতো উঠতে বসতে মা
ঠাকমার কথা শুনে চলে না। তের চোদ্দো বছরের ধাড়ি হয়েও এ পাড়া ও
পাড়া নেচে কুঁদে বেড়ায়।
দু তিন দিন বাদে সুস্থ হয়ে রতনমনির খেয়াল হল তার খোঁপায় যে দশটা
সোনার কাঁটা ছিল সে গুলো উধাও হয়ে গেছে। বড় কালো তালের মতো
খোঁপায় মোটা মোটা দশটা কাঁটা না বিঁধিয়ে রাখলে ফস করে যখন
তখন খুলে যায়। বিয়ের সময় ওর বাপ বাগান দিয়েছিল, আর শউর
বাড়ির অন্য গয়নার সঙ্গে এত্তো গুলো সূক্ষ্ম কারুকাজ করা কাঁটা।
রায়গড়ের স্যাকরা ছাড়া ওমন কাজ আর কেউ করতে পারে না। সেই
থেকে রতন কাঁটার ব্যাপারে খুব সজাগ।
মালতি ঝি অদূরে বসে মোটা মোটা সলতে পাকাছিলো, গলা নামিয়ে
ফিস ফিস করে বলল, "পেটেরটা বোধহয় ছেলে গো রতন দিদি, তাই
এত তোয়াজ। বোর গব্ব লক্ষন দেখে দিনু খুড়ো বলেছে, আমি আড়ি
পেতে শুনেছি। "
কথাটা আলটপকা বলে ফেলেই মনে মনে জিভ কাটল। সে বড় বাবুর
বিশেষ ভাবে নিযুক্ত চর। এ বাড়ির সবার সব খবর তাঁর কানে তোলে।
সে যে আড়ি পেতে অন্যের কথা শোনে সেটা সবাইকে জানানোর বিষয়
নয়। কিন্তু যে কথা একবার থেকে বের হয়ে গেছে তা আর ফেরায়
কী ভাবে। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলল, "ওই পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম
একটা কাজে, অমনি দিনু কবরেজের গলা পেলাম আর কি! জানই তো
কবরেজের কেমন বাজখাঁই গলা।"
ক্রমশ
কথাটা সবাই বুঝলেও কোন উত্তর দিল না। মালতী আর কথা না
বাড়িয়ে নিজের কাজে মন দিল। রোজ নিয়ম করে এই আসরে বসার
উদেশ্যও একই, খবর সংগ্রহ।
বিমলা আরও কিছু বলবে বলে মুখ তুলেই থেমে গেল। নতুন বউ উঠোনে
নামছে, সঙ্গে সবি ঝি। পেছনে তার দিদি শাশুড়ী।
.............
পরবর্তী পর্ব পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন
বউ ডুবির কথা (৩) ............
Alert message goes here